Advertisement

আনন্দের মধ্যেও অনেক দুঃখ ঋতুপর্ণার



আগের রাতে পাওয়া স্বপ্নের ট্রফিটা হাতে নিয়ে এদিক-ওদিক হাঁটছেন। কখনো দল বেঁধে সেলফি তুলছেন। কখনো সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন। অনুশীলনের তাড়া নেই, কোনো ম্যাচ নেই। আজ শুধুই হেসেখেলে বেড়ানোর দিন। দেশে ফিরলে আরেকবার ছাদখোলা বাসের রোমাঞ্চ। এসব ভাবতে ভাবতেই কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কালকের সকালটা কেটেছে ঋতুপর্ণা চাকমার।

ঢাকাগামী বিমানে ওঠার কিছুক্ষণ আগে দেখা গেল ঋতুপর্ণা ট্রফি নিয়ে রীতিমতো দৌড়াচ্ছেন। সঙ্গী মনিকা–মারিয়ারাও বেশ উপভোগ করছেন। সবার মুখে চওড়া হাসি। সাফ নারী ফুটবলে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পাওয়া বাংলাদেশ দলের ফরোয়ার্ড ঋতুপর্ণা হাসিটা অপরাজিত রেখে এই প্রতিবেদকের এক প্রশ্নে বললেন, ‘আমার সাফল্যে আমার পরিবার অনেক খুশি। মেয়ের সাফল্যে তারা খুশি হবে না?’

খুশি আসলে গোটা দেশের মানুষই। মেয়েরা টানা দ্বিতীয়বার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন। গতবার সাবিনার আলোয় ঢাকা পড়েছেন। এবার নিজেই আলো ছড়িয়েছেন। ফাইনালে ঋতুপর্ণা করেছেন জয়সূচক গোল।

বাংলাদেশের ২-১ গোলে জেতা ফাইনালটা রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের মঘাছড়ি গ্রামের মেয়েকে এনেছে আরও প্রচারের আলোয়। দশরথ রঙ্গশালায় এমন স্মরণীয় ক্ষণ কাটিয়ে রাতে ঘুম হয়েছে? প্রথমে ঘুম হয়নি বলে পরক্ষণে নিজেই সংশোধনী আনেন, ‘ঘুম হইছে, তবে একটু লেট হইছে।’

ঋতুপর্ণা টুর্নামেন্ট–সেরার পুরস্কার না পেলে কে পেতে পারতেন? ঋতুপর্ণার চোখে কে সেরা? প্রশ্ন শুনে ঋতুপর্ণা একটু ভাবেন। তারপর বলেন, ‘আমাদের দলের মনিকা মানে মনিকা চাকমা। মাঝমাঠে সে অনেক ভালো একটা প্লেয়ার। মাঝমাঠে কোয়ালিটি খেলোয়াড়।’

বাংলাদেশের এই নারী দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে ভেতরে-ভেতরে দলে জায়গা শক্ত করার লড়াই থাকলেও তাঁরা একে অন্যের প্রতি বেশ শ্রদ্ধাশীল। একজনের সাফল্যে আরেকজন উপভোগ করেন। সেই ছবিটা কাল দেখা গেছে দল দেশে ফেরার পথে। সবাই পুরো ভ্রমণ আনন্দে কাটিয়েছেন। বিমান দেশের মাটি ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে খেলোয়াড়দের করতালি দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। বিমানে তাঁদের আসনগুলোয় রজনীগন্ধা ফুল পড়ে ছিল। সকালে তাঁরা বিমানবন্দরে আসেন মালা পরে।

কিন্তু সেরার পুরস্কার নিয়ে ফেরার পথে ঋতুপর্ণার মনটা বিষণ্ন হয়ে ওঠে যখন তাঁর প্রয়াত বাবার প্রসঙ্গ আসে। মেয়ের ফুটবলার হওয়া বা তাঁর সাফল্য বাবা দেখে যেতে পারেননি। ঋতুপর্ণা বলে যান, ‘বাবা থাকলে আমার থেকেও অনেক খুশি হতেন। ছেলেমেয়েদের নিয়ে অন্য বাবারা যেমন গর্বিত হয়, তিনিও হতেন।’

পঞ্চম শ্রেণিতে পিইসি পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলের অপেক্ষা করছিলেন। ফল বেরোনোর কয়েক দিন পরই তাঁর বাবা বরজ বাঁশি চাকমা ক্যানসারে মারা যান ২০১৫ সালে। ঋতুপর্ণার বয়স তখন মাত্র ১১ বছর।


তাঁর একমাত্র ভাই পার্বণ চাকমা ২০২২ সালের জুনে মারা যান মর্মান্তিকভাবে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। ভাইয়ের কথা এলে ঋতুপর্ণার কণ্ঠটা আরও ধরে আসে। দুঃখ নিয়ে বলেন, ‘ভাই অনেক ভালো ছিলেন। অনেক ভালোবাসতেন আমাকে।’

সাফের আগের টুর্নামেন্টও ভাই দেখে যেতে পারেননি। চার বোনের মধ্যে বড় তিনজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। ঋতুপর্ণা নিজেই বলেন, ‘আমি আসলে এখন একা।’


গত বছর খেলোয়াড় কোটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনে ভর্তি হয়েছেন। তবে বাবা-ভাই হারানোর শোক বুকে নিয়ে ঋতুপর্ণা ফুটবলকেই সঙ্গী করে নিয়েছেন সার্বক্ষণিক।

মেয়েদের বঙ্গমাতা আন্তঃপ্রাথমিক ফুটবল দিয়ে তাঁর এই জগতে আসা। ২০১২ সালে টুর্নামেন্টের প্রথম আসরে খেলেন। ২০১৪ সালে সর্বশেষ খেলেছেন প্রাথমিকে। ২০১৬ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়া। একই সঙ্গে বাফুফে ছায়াতলে আসেন সেই সময়। ৮-৯ বছরের মধ্যেই মেয়েটি দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ফুটবলারে পরিণত হয়েছেন।


অনেকের ভিড়েই ঋতুপর্ণাকে আলাদাভাবে চেনা যায়। ছোটখাটো গড়ন। তবে মাঠে বেশ ক্ষিপ্র। তাঁর পায়ের কারুকাজে বারবার পরাস্ত হয়েছে নেপাল, ভারত, ভুটান, পাকিস্তানের ডিফেন্ডাররা। এবারের সাফে তাঁর গোল দুটি। কিন্তু গোল দিয়ে তাঁকে চেনা যাবে না। ঋতুপর্ণাকে চিনতে হলে দেখতে হবে তাঁর গতি আর স্কিলের ঝলক। তবে ঋতুপর্ণা যে মাঠে ঝলক দেখান বাবা-ভাই হারানোর দুঃখ নিয়ে, সেটি থেকে যায় আড়ালেই।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url

Advertisement

Advertisement

Advertisement

Advertisement